বিষয়বস্তুতে চলুন

কলা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

কলা
কলা
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস
জগৎ: উদ্ভিদ
শ্রেণীবিহীন: সপুষ্পক উদ্ভিদ
শ্রেণীবিহীন: মনোকোট্‌স
শ্রেণীবিহীন: কমেলিনিড্‌স
বর্গ: জিঞ্জিবেরালেস
পরিবার: মুসাকিয়া
গণ: মুসা
প্রজাতি: Musa acuminata

কলা এক প্রকারের বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ফল। সাধারণত উষ্ণ জলবায়ু সম্পন্ন দেশসমূহে কলা ভাল জন্মায়। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াই কলার উৎপত্তিস্থল হিসাবে পরিগণিত। বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর বহু দেশে কলা অন্যতম প্রধান ফল। বাংলাদেশের নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, ময়মনসিংহ, যশোর, বরিশাল, বগুড়া, রংপুর, জয়পুরহাট, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, প্রভৃতি এলাকায় শত শত বৎসর যাবৎ ব্যাপকভাবে কলার চাষ হয়ে আসছে। বাংলাদেশে কলা চাষের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল সারা বছর এ দেশের প্রায় সব অঞ্চলের উঁচু জমিতেই এর চাষ করা যায়। পার্বত্য এলাকায় বনকলা, বাংলাকলা, মামা কলাসহ বিভিন্ন ধরনের বুনোজাতের কলা চাষ হয়।[]কলম্বিয়া ইত্যাদি ল্যাটিন আমেরিকান দেশে কলা প্রধান অর্থকরী ফসল। প্রাগাধুনিক ভারতীয় অর্থনীতিতেও একটি প্রধান অর্থকরী ফসল হিসাবে কলার চাষাবাদ হতো। খনার বচনে আছে, "কলা রুয়ে না কেটো পাত, তাতেই কাপড়, তাতেই ভাত"।[]

গাছের বর্ণনা

[সম্পাদনা]
কলা গাছ থেকে ঝুলন্ত কলার কাঁদি।

উদ্ভিদ বিজ্ঞানী মালানের মতে ভারতবর্ষচীন কলার জন্মভূমি । কিন্তু আরেক উদ্ভিদ বিজ্ঞানী হিল পাক-ভারত ও মালয়কে কলার উৎপত্তিস্থল বিবেচনা করেছেন। কলাগাছ একটি বীরুৎ শ্রেণির উদ্ভিদ। আবার এটি একবীজপত্রী উদ্ভিদ। অধিকাংশ জাতের গাছই বহুবর্ষজীবী । মাটির নিচে রাইজোম বা কন্দ এবং মাটির ওপরে একটি ছদ্মকাণ্ড বা সিউডোস্টেম নিয়ে এ গাছ গঠিত। কাণ্ড ও পাতা উভয়ই সবুজ।

কাঁচা কলা সবুজ, পেকে গেলে তা হলুদ হয়ে যায়। কলাপাতা সরল, পত্রভিত পুরু ও পত্রফলক প্রশস্ত।। পত্রফলকে দৃঢ়, মোটা ও সুস্পষ্ট ও মধ্যশিরা বিদ্যমান। মধ্য শিরার দুই পাশে সমান্তরাল শিরাগুলো বিন্যাসিত হয়। একান্তরক্রমে পাতাগুলোর উৎপত্তি ঘটে । পুষ্পমঞ্জুরী স্পেডিক্স ধরনের এবং নৌকার মত স্পেদ দ্বারা আবৃত থাকে। পুষ্পমঞ্জুরি গোড়ার দিকে ও আগার দিকে পুরুষ এবং নিরপেক্ষ ফুল থাকে। ফুল সাধারণত একপ্রতিসম উভলিঙ্গ। তবে কখনো কখনো একলিঙ্গ পুষ্পও দেখা যায় । ফুলের ব্রাক্টের রঙ অ্যান্থসায়ানিনের জন্য লালচে, গোলাপী বা বেগুনী হয়ে থাকে । ফুলে ছয়টি পাঁপড়ি পরস্পর ৩টি করে ২টি আবর্তে সজ্জিত থাকে। এগুলো যুক্ত বা পৃথক উভয়ভাবেই বিন্যস্ত থাকতে পারে। ফুলে পুংকেশর ৫টি, সবগুলোই উর্বর। যখন ৫টি দেখা যায় তখন অন্যটি অনুন্মোচিত বা অনুপস্থিত থাকে। স্ত্রী স্তবকের ৩টি গর্ভপত্র সংযুক্ত অবস্থায় দেখা যায় । ডিম্বাশয় অধোগর্ভ এবং তিনটি প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট। এর অমরাবিন্যাস অক্ষীয় ধরনের এবং ফল একক, সরস, ও বেরি(Berry) প্রকৃতির ।

প্রজাতি ও জাত

[সম্পাদনা]
কলার মোচা

কলা Musaceae পরিবারের একটি উদ্ভিদ। এর দুটি গণ আছে যথা: Ensete ও Musa। এ পরিবারে প্রায় ৫০টি প্রজাতি অন্তর্ভুক্ত । Ensete গণের মাত্র ৬-৭টি প্রজাতি আছে, তবে এর মধ্যে মাত্র একটি প্রজাতি এ পর্যন্ত ইথিওপিয়ায় জন্মানো সম্ভব হয়েছে। Musa গণের প্রায় ৪০টি প্রজাতি রয়েছে। এর অধিকাংশ প্রজাতির উৎপত্তি দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায়। প্রায় সব আবাদকৃত কলাই এ প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত । এই গণকে আবার ৫টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। বাংলাদেশে প্রায় ১৯টি জাত রয়েছে । পার্বত্য এলাকায় বাংলা কলা, বন কলা, মামা কলা ইত্যাদি নামেও কলার কিছু বুনো জাত দেখা যায়। ক্রমশ কলার জাতের সংখ্যা বাড়ছে। গাছের বৈশিষ্ট্য অনুসারে বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতের কলা গাছকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে যথা: লম্বা জাতের গাছ ও খাটো জাতের গাছ। পাকা অবস্থায় খাওয়ার জন্য কলার জাত ৪ প্রকার যথা:

হলুদবর্ণ পাকা কলা
  • সম্পূর্ণ বীজমুক্ত কলা: যেমন-সবরি, অমৃতসাগর, অগ্নিশ্বর, দুধসর, দুধসাগর প্রভৃতি ।
  • দু-একটি বীজযুক্ত কলা: যেমন-চাম্পা, চিনিচাম্পা, কবরী, চন্দন কবরী, জাবকাঠালী ইত্যাদি ।
  • বীজযুক্ত কলা: এটেকলা যেমন-বতুর আইটা, গোমা, সাংগী আইটা ইত্যাদি ।
  • আনাজী কলাসমুহ: যেমন-ভেড়ার ভোগ, চোয়াল পউশ, বর ভাগনে, বেহুলা, মন্দিরা, বিয়েরবাতি প্রভৃতি।

কলার গুণাগুণ

[সম্পাদনা]

কলা বিভিন্ন গুণাগুণে সমৃদ্ধ একটি ফল। এর পুষ্টিগুণ অধিক। এতে রয়েছে দৃঢ় টিস্যু গঠনকারী উপদান যথা আমিষ, ভিটামিন এবং খনিজ। কলা ক্যালরির একটি ভাল উৎস। এতে কঠিন খাদ্য উপাদান এবং সেই সাথে পানি জাতীয় উপাদান সমন্বয় যে কোন তাজা ফলের তুলনায় বেশি। একটি বড় মাপের কলা খেলে ১০০ ক্যালরির বেশি শক্তি পাওয়া যায়। কলাতে রয়েছে সহজে হজমযোগ্য শর্করা। এই শর্করা পরিপাকতন্ত্রকে সহজে হজম করতে সাহায্য করে। কলার মধ্যে থাকা আয়রন রক্তে হিমোগ্লোবিন উত্‍পাদনে সাহায্য করে। গবেষকরা জানান, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ এবং স্বাভাবিক রক্তপ্রবাহ নিশ্চিত করতে দেহে পটাশিয়ামের উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি। এছাড়াও দেহে পটাশিয়ামের আদর্শ উপস্থিতি নিশ্চিত করা গেলে কমে যায় স্ট্রোকের ঝুঁকিও। আর এই উপকারী পটাশিয়াম কলায় আছে প্রচুর পরিমাণে। [] গবেষকরা দেখেছেন, একটি কলায় প্রায় ৫০০ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম থাকে। আর মানবদেহে প্রতিদিন ১৬০০ মিলিগ্রাম পটাশিয়ামের যোগান দেয়া গেলেই স্ট্রোকের হাত থেকে বছরে বেঁচে যেতে পারে ১০ লক্ষ মানুষ। এছাড়া কলাতে আছে ভিটামিন বি৬ থাকে যা গ্লুকোজকে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে সাহায্য করে। এর ফলে মস্তিষ্কের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া এতে থাকা আয়রন শিশুদের  মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয়।

খাদ্যগুণ

[সম্পাদনা]

প্রতি ১০০ গ্রাম পরিমাণ কলায় যে খাদ্যগুণ আছে তার বিশ্লেষণ নিম্নরূপ:

প্রতি ১০০ গ্রাম পরিমাণ কলায়
উপাদান পরিমাণ
জল ৭০.১%
আমিষ ১.২%
ফ্যাট (চর্বি) ০.৩%
খনিজ লবণ ০.৮%
আঁশ ০.৪%
শর্করা ৭.২%
মোট ১০০.০%

[]

খনিজ লবণ এবং ভিটামিন
উপাদান পরিমাণ
ক্যালসিয়াম ৮৫মি.গ্রা.
ফসফরাস ৫০মি.গ্রা.
আয়রন ০.৬মি.গ্রা.
ভিটামিন-সি, অল্প ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স ৮মি.গ্রা.
মোট ক্যালরি ১১৬মি.গ্রা.

[]

কলা চাষ

[সম্পাদনা]
কাঁদি থেকে কলা বের হচ্ছে

কলার চারা বছরে তিন মৌসুমে রোপণ করা যায়। প্রথম মৌসুম মধ্য জানুয়ারি থেকে মধ্য মার্চ। দ্বিতীয় মৌসুম মধ্য মার্চ থেকে মধ্য মে। তৃতীয় মৌসুম মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে মধ্য নভেম্বর। সাত-আটবার চাষ দিয়ে জমি ভালোভাবে তৈরি করে নিতে হয়। অতঃপর জৈবসার (যেমন গোবর, কচুরিপানা ইত্যাদি) হেক্টরপ্রতি ১২ টন হিসেবে প্রয়োগ করতে হবে। অতঃপর ২–২ মিটার দূরত্বে গর্ত খনন করতে হবে। প্রতিটি গর্তে ৬ কেজি গোবর, ৫০০ গ্রাম খৈল, ১২৫ গ্রাম ইউরিয়া, ২৫০ গ্রাম টিএসপি, ১০০ গ্রাম এমপি, ১০০ গ্রাম জিপসাম, ১০ গ্রাম জিংক এবং ৫ গ্রাম বরিক এসিড প্রয়োগ করে মাটি দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। ১৫ দিন পর প্রতিটি গর্তে নির্ধারিত জাতের সতেজ ও সোর্ড শাকার (তরবারি চারা) চারা রোপণ করতে হবে। এভাবে একরপ্রতি সাধারণত ১ হাজার থেকে ১ শত চারা রোপণ করা যায়। চারা রোপণের পর ২ কিস্তিতে গাছপ্রতি ১২৫ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম এমপি ৩ মাস অন্তর অন্তর প্রয়োগ করতে হবে। শুকনো মৌসুমে ১৫-২০ দিন পর পর সেচের প্রয়োজন হয়। গাছ রোপণের প্রথম অবস্থায় ৫ মাস পর্যন্ত বাগান আগাছামুক্ত রাখা জরুরি। কলাবাগানে জলাবদ্ধতা যেন না হয়, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। সাধারণত কলাতে বিটল পোকা, পানামা রোগ, বানচিটপ ভাইরাস ও সিগাটোকা রোগ আক্রমণ করে থাকে। বিটল পোকায় আক্রান্ত হলে কলা সাধারণত কালো কালো দাগযুক্ত হয়। প্রতিরোধের জন্য ম্যালথিয়ন অথবা লিবাসিস ৫০ ইসিসহ সেভিন ৮৫ ডব্লিউপি প্রয়োগ করা যেতে পারে। পানামা রোগে সাধারণত কলাগাছের পাতা হলুদ বর্ণ ধারণ করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গাছ লম্বালম্বি ফেটে যায়। এ রোগের প্রতিরোধে গাছ উপড়ে ফেলা ছাড়া অন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। বাঞ্চিটর ভাইরাসে আক্রান্ত হলে কলার পাতা আকারে ছোট ও অপ্রশস্ত হয়। এটি দমনের জন্য রগর বা সুমিথিয়ন পানিতে মিশিয়ে প্রয়োগ করা যেতে পারে। সিগাটোগায় আক্রান্ত হলে পাতায় ছোট ছোট হলুদ দাগ দেখা যায়। এক সময় এ দাগগুলো বড় ও বাদামি রং ধারণ করে। এ অবস্থা দেখা দিলে আক্রান্ত গাছের পাতা পুড়িয়ে ফেলতে হবে এবং মিলিটিলট-২৫০ ইসি অথবা ব্যাভিস্টিন প্রয়োগ করা যেতে পারে।

উৎপাদন

[সম্পাদনা]

২০১৭ সালে সারা বিশ্বে পাকা কলা এবং কাঁচা কলার মোট উৎপাদন ছিল ১৫৩১ লক্ষ টন। মোট উৎপাদনের ২৭% এর বেশি ভারত ও চীন এই দুটি দেশ মিলে করেছিল।[][]

চিত্রশালা

[সম্পাদনা]

আরও দেখুন

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. "বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধ"। ২২ জুলাই ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮ 
  2. "Banana Nutrition Facts"। ৮ আগস্ট ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২২ নভেম্বর ২০১০ 
  3. স্কুল অফ পাবলিক হেলথ, হার্ভাড। "Bananas | The Nutrition Source | Harvard T.H. Chan School of Public Health"Harvard T.H. Chan School of Public Health। সংগ্রহের তারিখ ৮ মার্চ ২০২২ 
  4. "EST: Banana facts"www.fao.org। জুলাই ১৮, ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৫-২৮ 
  5. "Global leading producers of bananas 2017"Statista (ইংরেজি ভাষায়)। জুলাই ২৬, ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৫-২৮ 

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]
pFad - Phonifier reborn

Pfad - The Proxy pFad of © 2024 Garber Painting. All rights reserved.

Note: This service is not intended for secure transactions such as banking, social media, email, or purchasing. Use at your own risk. We assume no liability whatsoever for broken pages.


Alternative Proxies:

Alternative Proxy

pFad Proxy

pFad v3 Proxy

pFad v4 Proxy